পেশা হিসেবে ভেটেরিনারি মেডিসিন : সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিক্ষেত্রে আমুল উন্নয়নের জন্য প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন অপরিহার্য। আর এ প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে প্রয়োজন দক্ষ ভেটেরিনারিয়ান। প্রাণী চিকিৎসকরাই সাধারণত ভেটেরিনারিয়ান হিসেবে পরিচিত। একটি দেশের পুষ্টি বিশেষ করে প্রোটিন, আমিষের চাহিদার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করেন প্রাণী চিকিৎসকরাই। বিভিন্ন গবেষণা, বিভিন্ন প্রাণির নতুন জাত উদ্ভাবন ও জাত উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি যেমন- দুগ্ধ উৎপাদন, ডিম উৎপাদনে এ ভূয়সী ভূমিকা রাখেন তারা। বিশ্বে যতগুলো সাবজেক্ট আছে তন্মধ্যে
ভেটেরিনারি অন্যতম most wanted subject.

বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষা সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের মধ্যে ধারনা কম ছিল, তবে বর্তমানে এ দেশে ভেটেরিনারিয়ানদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং কাজের সুযোগের পরিধিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এনথ্রাক্স, বার্ডফ্লু প্রভৃতির মতো ভয়াবহ zoonotic disease এর প্রাদুর্ভাবের ফলে ভেটদের চাহিদাও এখন প্রচুর। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ভেটেরিনারি অতীব পরিচিত একটা বিষয়, কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে এ পেশার যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও লোকজন ততটা সচেতন নন।

১৮ কোটি মানুষের এ দেশে ভেটেরিনারি শিক্ষাকে আরো গুরত্ব সহকারে না দেখলে পুষ্টি, খাদ্য সমস্যার সমাধান, শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি কোনটায় সম্ভব নয়।

সৃষ্টির উষালগ্ন সেই আদিকাল হতে আদিম বনবাসী, গুহাবাসী মানুষ সভ্যতার আলো দেখেছিল পশুপাখির হাত ধরে। যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী,বছরের পর বছর মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে ( যেমন -যাতায়াত-যোগাযোগ, অর্থনৈতিক নির্ভরতা, খাদ্যেও নির্ভরতা, সৌর্দয্য চর্চা, একাকীত্ত্বেও বন্ধু, পাহারাদারি, অবর্থ্য গোয়েন্দাগিরি ইত্যাদি ) পশুপাখি ব্যবহৃত হচ্ছে।

তাই কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য সবার আগে প্রয়োজন livestock agro based revolution. এই গুরুত্বপূর্ণ ভেটেরিনারি শিক্ষা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় শিক্ষার্থী এমনকি অভিবাবকরাও ক্যারিয়ার গঠনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাই ভেটেরিনারি শিক্ষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছি…

ভেটেরিনারি শিক্ষা একটা প্রফেশনাল শিক্ষা যা ভেটেরিনারি কাউন্সিল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যেমন- মেডিকেল কাউন্সিল, বার কাউন্সিল ইত্যাদির মত।

১. ভেটেরিনারি শিক্ষা এখন মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অনান্য সমমানের পেশার মত সমমান মর্যাদাপূর্ণ একটা পেশা।

২. শেষের দিকের মেডিকেলে পড়ার চেয়ে ভেটেরিনারীতে পড়া অনেক ভাল যা আজ ভুক্তভুগীরাই জানে।

৩. ভেটেরিনারির ছাত্র হিসেবে প্রতি মাসে আপনি পাচ্ছেন দু’শত টাকা করে বৃত্তি যা ব্যাতিক্রম। এছাড়া ইন্টার্ণশীপ সময়ে আপনি পাচ্ছেন প্রতিমাসে ৫-৮ হাজারা টাকা যা ভেটেরিনারি ও মেডিকেলেই সম্ভব।

৪. একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার হতে হলে তাকে অধ্যায়ন করতে হয় : এনাটমি, হিস্টোলজি, অ্যানিম্যাল সায়েন্স, নিউট্রিশন, পোল্ট্রি সায়েন্স, ডেইরী সায়েন্স, ফিজিওলজি, বায়োক্যামিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি ও থেরাপিউটিক্স টক্সিকোলজি, প্যাথলজি, প্যারাসাইটোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ব্যাক্টেরিওলজি, ভাইরোলজি, সেরোলজি, এনিম্যাল জেনেটিক্স ও ব্রিডিং, মেডিসিন, সার্জারী, ভেটেরিনারি এপিডিমিওলজি, গাইনীকোলজী ও অবস্ট্রাট্রিক্স, থ্রেরিওজেনোলজি, রেডিওলজী- ল্যামনেস এন্ড সাউন্ডন্যাস, অপারেটিভ সার্জারী, পরিসংখ্যান, গ্রামীন সমাজবিজ্ঞান, কৃষি অর্থনীতি, মার্কেটিং, কৃষি সম্প্রসারন বিদ্যা, ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ প্রভৃতি বিয়য়াদি।

৫. পড়াশোনার শেষ বছরে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বাইরে ইন্টার্ণশীপের সুযোগ রয়েছে, যা ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ জীবনে অনেক ভূমিকা রাখে।

৫. বর্হিবিশ্বে scholarship এর দ্রুত সুযোগ ভেটেরিনারি মত অন্য কোন subject এ সম্ভব নয়।

৬. দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে যেমন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ফিনল্যান্ড, আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে সম্মানজনক চাকুরির সুযোগ ভেটেরিনারী পেশার ক্ষেত্রে সহজ যা http://www.jobrapido.com   ভিজিট করলেই বোঝা যাবে। এ সব দেশ গুলোতে উন্নত বেতনের লোভনীয় অফার রয়েছে ,পদ ও যোগ্যতা অনুযায়ী লাখ লাখ টাকা উপার্জন করা যায়।

৬. দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে একই common subject হতে bangla, english, physics, math, social science etc.) প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী এক সাথে বের হয়, ফলে চাকুরির বাজারে স্বল্প বেতনের চাকুরি খুঁজতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যায়, অন্য দিকে veterinary graduate দের চাকুরির বেতন শুরু হয় ২৫,০০০-২৭,০০০ টাকা হতে ।

৭. বিদেশে scholarship পাওয়া সহজ ভেটেরিনারি হতে যা ইন্টারনেট খুজলেই পাওয়া যাবে।

৮. DVM পাশ করার পর যেকোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে microbiology, biochemistry, pharmacy সহ যে কোন Subject এ MS করার সুযোগ রয়েছে।

৯. BCS এ রয়েছে special cota veterinary graduate দের জন্য। এছাড়া BCS এ VET রা অনান্য ক্যাডারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবে।

১০. বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেমন ICDDRB, BLRI, LRI, FRI এগুলোতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার ও বিদেশ ভ্রমনের সুযোগ রয়েছে।

১১. বিভিন্ন পোষা প্রানী যেমন- বিড়াল, কুকুর, বিভিন্ন জাতের পাখির চিকিৎসা করেও এই পেশায় উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়া যায়।

১২. সেনাবাহিনীতে ভেটেরিনারি পেশার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কোর যার নাম RVFC(Remount Veterinary and Farm core) এবং বছরে ২ বার এ সুযোগ পাওয়া যায় সরাসরি সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে।

১৩. আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় ঔষধ কোম্পানীগুলোতে ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য নির্দিষ্ট আসন রয়েছে।

১৪. বিভিন্ন livestock product company যেমন- Ice cream, juice, butter, candy, cola, milk & meat industry তে কাজ করার অপার সুযোগ। বিভিন্ন কোম্পানী যেমন- Pran, Milk vita, Arong, Aftab, RD Milk, BRAC meat, Bengal Meat ইত্যাদি কোম্পানীতে বেতন ৩০,০০০-৪০,০০০ টাকা। ৬টি বোনাসসহ গাড়ী ও বাড়ি সুবিধা ।

১৫. এছাড়া বিভিন্ন চর এলাকায় নানা project এ কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন- CLP PKSF, BRAC   ইত্যাদি বেতন -২৫,০০০-৩০,০০০ টাকা।

১৬. দেশের বিভিন্ন feed mill, hatchery এ আকর্ষণীয় বেতনের চাকুরীর সুযোগ রয়েছে। যেমন – Kazi farms, Aftab, Paragoan, Nourish, Anchor feeds, Dhaka hatchary, Eggs & Hens, Rafid, Universal, Goalanda, Denim, Bangladesh hatchery ইত্যাদি।

১৭. অনেকের মধ্যে একটা থাকে যে, confusion ভেটেরিনারি পড়ে অন্য কোন চাকরী করা যাবে কিনা? তাদের জন্য বলি চিন্তার কোন কারণ নাই। কেহ যদি ডাক্তারী পেশা নিতে ইচ্ছুক না হয়, তাহলে এই গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি দিয়ে বিভিন্ন অফিস, ব্যাংক এ মর্যাদাপূর্ন চাকরী করা যাবে।

১৮. বিভিন্ন চিড়িয়াখানায়, সাফারী পার্কে , সুন্দরবনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও চিকিৎসক হিসেবে চাকুরীর সুযোগ রয়েছে।

১৯. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন, পাবলিকেশন এ চাকরীর সুযোগ রয়েছে।

২০. বিভিন্ন Media যেমন- Animal Planet, Discovery, National Geography এগুলোতে Handsome বেতনের চাকরীর সুযোগ রয়েছে।

২১. প্রথম শ্রেণির পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, পাঁচ তারা হোটেলগুলোতে Meat Inspector, Public Health Officer হিসেবে চাকরীর সুযোগ রয়েছে।

২২. Quarantine এর নিমিত্তে আমদানী রপ্তানী প্রতিষ্ঠানে Animal Product, Fish Product ইত্যাদি আমদানী রপ্তানীর ক্ষেত্রে ভেটেরিনারিয়ানদের চাকরীর সুযোগ রয়েছে।

২৩. কেবলমাত্র DVM ডিগ্রিধারীরাই BCS এ ২৯ ক্যাডারের এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্যাডারে আবেদন করতে পারে।

২৪. একজন ভেটেরিনারিয়ান এর Private Practice, Farm Business, Laboratory, Vaccine এ কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানী যেমন ACME laboratory, SQUARE pharmaceuticals, RENETA, EON group, BEXIMCO pharmaceuticals, OPSONIN pharmaceuticals, FNF pharmaceuticals, TECHNO pharmaceuticals, RAMPAT POWER pharmaceuticals, SKF pharmaceuticals, NOVERTIS pharmaceuticals, POPULAR pharmaceuticals ইত্যাদি বড় বড় pharmaceuticals এর এ্যানিম্যাল ডিভিশন এ Technical officer / Area manager / Technical support officer / consultant হিসেবে নিশ্চিত সুযোগ রয়েছে।

দেশের ভেটেরিনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বর্তমান অবস্থা :

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ এ মাত্র ৮০০ জন ছাত্র-ছাত্রী প্রতি বছর এ সম্মানজনক ডিগ্রি গ্রহনের সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া সিরাজগঞ্জে আরও একটি ভেটেরিনারি কলেজের কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

পরিশেষে বলা যায় ক্যরিয়ার গঠনে ভেটিরিনারি শিক্ষা গ্রহন অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত।

সূত্র :

১. প্রফেসর ডা: এ কে এম .সাইফুদ্দিন ,২০০৯, ক্যারিয়ার গঠনে ভেটেরিনারি শিক্ষা।

২. ডা: অনুপ কুমার তালুকদার, ২০১১, বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষা : ১৯৪৭-২০১১, রংধনু ম্যাগাজিন  (বর্ষপূর্তি সংখ্যা ১৪১৮)।

৩. ইন্টারনেট

৪. বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট।

৫. http://www.jobrapido.com

মূল লেখক : মো: মুস্তাফিজুর রহমান, সাধারন সম্পাদক,  ভেটেরিনারি স্টুডেন্ট’স এ্যাসোসিয়েশন ( ভিএসএ), পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি স্টুডেন্টস ফেডারেশন ( বিভিএসএফ) কেন্দ্রীয় কমিটি।