ইউটিউব চ্যানেলে আয় কত?

গান, নাটক, চলচ্চিত্র, টিভি অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে এমন কোনো কনটেন্ট নেই যে আমরা ইউটিউবে দেখতে পাই না। বিনোদনের প্রধান মাধ্যম এখন ইউটিউব। টেলিভিশনের জন্য নয়, শুধু ইউটিউবকে কেন্দ্র করেও নির্মিত হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও খুলছেন ইউটিউব চ্যানেল। সর্বোপরি বাংলাদেশের বিনোদন জগৎ এখন অনেকটাই ইউটিউবকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। সংগীতাঙ্গনের এখন প্রায় শতভাগ বিনিয়োগই ইউটিউবকে ঘিরে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের যেমন ইউটিউব চ্যানেল আছে, তেমনি অনেক কণ্ঠশিল্পীরই নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। শুধু
মিউজিক কোম্পানি কেন, বর্তমানে দেশের প্রতিটি টিভি চ্যানেলেরও রয়েছে আলাদা ইউটিউব চ্যানেল। আর শুধু ইউটিউবকে কেন্দ্র করে খুব কম সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় ডজনখানেক মানসম্পন্ন মিউজিক চ্যানেল। এ ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে রয়েছে অগণিত চ্যানেল। ইদানীং অনেক উঠতি নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা ইউটিউব চ্যানেলকেন্দ্রিক কাজ করতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু কেন? ইউটিউবের ব্যবসাটা আসলে কোথায়?

মুখে মুখে প্রচলিত আছে, কোনো গান, নাটক বা সিনেমা কিংবা যে কোনো কনটেন্ট ইউটিউবে এক কোটিবার দর্শক দেখলে ওই চ্যানেল মালিক ছয় লাখ টাকা পাবেন ইউটিউব কোম্পানি থেকে। কেউ কেউ বলেন, লাখ ভিউতে ২৩শ টাকা পাওয়া যায়। কোটি ভিউতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০-৫০ হাজারও পাওয়া যেতে পারে। আবার ৫-১০ লাখ টাকাও পাওয়া যেতে পারে। বিষয়টি সম্পূর্ণই নির্ভর করছে ওই ভিডিওটি কোন মহাদেশের দর্শক বেশিবার দেখেছে তার ওপর। বিষয়টি আরও একটু খোলাসা করা যাক। ইউটিউব চ্যানেলের একটি ভাষা হচ্ছে ‘কস্ট পার ভিউ’। অর্থাৎ একটি ভিডিও একবার দেখতে কত টাকা খরচ করছেন একজন দর্শক। ইন্টারনেটে একজন দর্শক এমবি (মেগাবাইট) কিনে যে পদ্ধতিতে (মোবাইল, ওয়াইফাই ইত্যাদি) ভিডিওটি দেখছেন, তাতে একটি ভিডিও দেখতে যে পরিমাণ এমবি খরচ হচ্ছে তাকেই বলা হচ্ছে কস্ট পার ভিউ। প্রাথমিক হিসাবে মহাদেশ অনুযায়ী এই কস্ট পার ভিউ এশিয়া মহাদেশে মাত্র ৮ পয়সা, মধ্যপ্রাচ্যে ৪-৫ টাকা, আফ্রিকা মহাদেশে ১ টাকা, কানাডায় ৭-৮ টাকা, আমেরিকায় ৫-৬ টাকা, অস্ট্রেলিয়ায় ৪-৬ টাকা আবার এশিয়ার কোনো কোনো দেশে ২-৩ টাকা। এখন একটি ভিডিও কোটি ভিউ হলে যদি সেই ভিডিওর দর্শক বেশিরভাগই এশিয়া বা আফ্রিকাকেন্দ্রিক হয়, তা হলে রেভিনিউ অনেক কম পাওয়া যায়। আবার কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দর্শক যদি বেশি দেখেন, তা হলে রেভিনিউ অনেক বেশি পাওয়া যাবে। সুতরাং কোটি ভিউতে ছয় লাখ টাকা পাওয়া যায়, এমনভাবে নিশ্চিত কোনো হিসাব নেই। যিনি চ্যানেলের মালিক তিনি প্রতিদিনই তার রেভিনিউর পরিমাণ সহজেই দেখতে পারেন। ইউটিউবের একটি নির্দিষ্ট সার্ভার প্রতিদিনই প্রতিটি চ্যানেলে রেভিনিউ হিসাব করে সেটির আপডেট দিয়ে দিচ্ছে।

খুবই মজার বিষয় হলো, সারা বিশ্বে ইউটিউবের হাজার কোটি চ্যানেলেকে কন্ট্রোল করছে একটি রোবট। শুধু কন্ট্রোল নয়, চুরি করে অন্য কারো গান, নাটক বা সিনেমা হঠাৎ করে আরেকটি চ্যানেলে প্রচার হচ্ছে কিনা, সেটিও বিচার করছে এই রোবট এবং ক্লেম (অভিযোগ) করে ভিডিওটি ডিলিট করে দিচ্ছে। এভাবে ওই রোবটের মাধ্যমে তিন মাসে কোনো একটি চ্যানেল যদি তিনবার ক্লেমের আওতায় পড়ে, তা হলে ওই চ্যানেল অটো বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ইউটিউব মূলত আমেরিকান কোম্পানি। তবে যে কেউ ইচ্ছে করলেই কয়েক মিনিটের ব্যবধানে একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে রয়েছে দুটি বিষয়। এক. চ্যানেল খুললেন, বিভিন্ন ভিডিও-অডিও আপলোড করছেন, কিন্তু আপনি কোনো রেভিনিউ পাবেন না। দুই. রেভিনিউ পেতে হলে আপনাকে নির্দিষ্ট একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সেটি হয় আমেরিকা অথবা সিঙ্গাপুর। যেটি আপনার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে শরণাপন্ন হতে হবে কোনো না কোনো এমসিএনের (মাল্টি চ্যানেল নেটওয়ার্ক)। বাংলাদেশে এখন ৮-৯টি এমসিএন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে এবং সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। এ রকমই একটি প্রতিষ্ঠান লাইকা নেটওয়ার্ক। লাইকা নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী রায়হান শরীফ বলেন, ‘যে কেউ চ্যানেল খুলতে চাইলেই আমরা তাকে সহযোগিতা করি এবং সে তার চ্যানেলে যে কোনো কনটেন্ট আপলোড নিজেই করতে পারবেন। কনটেন্ট ক্লেমের ক্ষেত্রেও আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি। সবচেয়ে বড় কথা, একটি চ্যানেল খুললেই কিন্তু লাখ লাখ ভিউ পাওয়া যায় না। এর জন্য প্রয়োজন প্রমোশন আর সাবস্ক্রাইবার বাড়ানো। এ বিষয়গুলোয় আমরা সহযোগিতা করি।’ এতে করে আপনাদের লাভ কী? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যার সঙ্গে আমাদের চুক্তি হবে চ্যানেলের বিষয়ে ওই চুক্তিতেই উল্লেখ থাকবে রেভিনিউর ২০ ভাগ আমরা পাব। অর্থাৎ কোনো চ্যানেল ১০০ ডলার ইউটিউব থেকে পেলে আমরা নেব ২০ ডলার, চ্যানেল মালিক পাবেন ৮০ ডলার।’

ডলার তো আপনাদের অ্যাকাউন্টে জমা হবে, সে ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার প্রশ্ন আসতে পারে। রায়হান শরিফ জানান, এ ব্যবসাটির রেভিনিউতে পূর্ণ স্বচ্ছতা রয়েছে। যিনি চ্যানেল মালিক, তিনি প্রতিদিনই তার রেভিনিউ ইউটিউবেই সরাসরি দেখতে পাবেন।

সময়ের আরেকটি আলোচিত এমসিএন প্রতিষ্ঠান কাইনেটিক মিউজিক। কাইনেটিক মিউজিকের মুখপাত্র সংগীতশিল্পী জুয়েল মোর্শেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মালিকদের কাছ থেকে রেভিনিউর ৩০ ভাগ আমরা নিচ্ছি। এটি আসলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্ভর করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমবেশিও হতে পারে। গান প্রসঙ্গে জুয়েল মোর্শেদ বলেন, ‘গানের রেভিনিউ অন্য কনটেন্টের তুলনায় একটু কমই আসে। কারণ ৩-৪ মিনিটের গানে বিজ্ঞাপন শো একবারই করে। সে ক্ষেত্রে কনটেন্ট যদি ১০ মিনিটের ওপরে হতো তা হলে বিজ্ঞাপন শো কয়েক বার হতো। সে ক্ষেত্রে রেভিনিউয়ের পরিমাণও বাড়ত।’

বর্তমানে বাংলাদেশে ইউটিউব চ্যানেলগুলোর মধ্যে অনেক চ্যানেলই প্রতিমাসে ৫০ হাজার থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছে। শিল্পীদের মধ্যে যাদের নিজস্ব চ্যানেল রয়েছে, তারা প্রতিমাসে কমপক্ষে ২৫ হাজার থেকে প্রায় দুই লাখ টাকা পাচ্ছেন। আর মিউজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বেশ সম্মানজনক অঙ্কের টাকা আয় করছে। জানা গেছে, এর পরিমাণ এক লাখ থেকে ১২-১৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ রেভিনিউ পাচ্ছে ইউটিউব থেকে তাদের মধ্যে রয়েছেÑ সিডি চয়েস, ধ্রুব মিউজিক স্টেশন, সংগীতা, জি-সিরিজ প্রমুখ প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশে এখন এমন কিছু ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে যেগুলো উল্লিখিত চ্যানেলগুলোর চেয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি অর্থ উপাজর্ন করছে। কিন্তু সেসব চ্যানেল আসলে অশ্লীলতা বা তথাকথিত কিছু বিতর্কিত কনটেন্টে ভরপুর। আবার কিছু গুঞ্জন বা গসিফনির্ভর চ্যানেল রয়েছে, যেগুলো তাদের মনগড়া তারকা সংবাদের অডিও দিয়ে তারকাদের ছবি ব্যবহার করে ইউটিউবে আপলোড করে অর্থ কামাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিনেত্রী বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত ২০টি নাটকে অভিনয় করেছি। কিছু কিছু নাটকে বেশ বড় চরিত্রেই কাজ করেছি। কিন্তু কেউ আমাকে চেনে না। খোদ আমার অনেক আত্মীয়স্বজনই প্রশ্ন করেন, নাটকে কাজ করছিস কোনো দিন তো দেখলাম না টিভিতে? আসলে এত চ্যানেলের ভিড়ে কোন নাটক কোন চরিত্র কখন চলে যাচ্ছে দেখার কেউ নেই। সে দিক দিয়ে ইউটিউবকেন্দ্রিক চ্যানেলে কাজ করলে চাইলেই দেখাতে পারব আমার কাজ। লাখ লাখ দর্শক আমাকে ইউটিউবে দেখছে এটিই তো প্রশান্তি।’

সংগীতশিল্পী আসিফ আকবরের ইউটিউব চ্যানেল ‘আসিফ’-এর সাবস্ক্রাইবার এক লাখ পার করেছে (১ লাখ ২৪ হাজার ২৫৯)। ইউটিউব প্রসঙ্গে আসিফ আকবর বলেন, ‘এক সময় আমি নিজে ইউটিউব নিয়ে ভাবিনি। সময় আমাকে এসব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। নিজের ইউটিউব চ্যানেল প্রকাশ করি। গান গাওয়া নিয়ে যে অলসতা ভর করেছিল অর্ধযুগ আগে, সেই অলসতা এখন হাজার মাইল দূরে অবস্থান করছে। এখন গান আর শুটিংয়ে নিজেকে এমনভাবে বদলে নিয়েছি যে, মনে হয় নতুন করে ক্যারিয়ারে সংগ্রাম করছি। আগামী যুগে যদি দেখি কোনো টিভি চ্যানেলই নেই, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেননা টিভি চ্যানেলও সব ধীরে ধীরে ইউটিউবকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে।’